সময়টা ১৯৮৬ র বাংলা। কলকাতায় অন্যরকম মরশুম। অনেকরকম ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প জুড়ে জীবন চলছে লোকের। এরই মধ্যে দুটো বাড়ির কথা বলি - দুটো ঘর,পাশাপাশি পাড়ায় অবস্থিত। তবু খুব যে দুই পরিবারের মধ্যে ভাব আহ্লাদ ছিল এমন বলা যায় না। একটা যোগসূত্র ছিল যেটা এতোটাই সূক্ষ্ম এবং অদৃশ্য যে সহজে ঠাহর করা যায় না। সূত্র হলো দুইটি মানুষ; সমরেশ ও ললিতা। দুইজনই কলেজে পড়ে এবং তাদের পরিবার তথাকথিতভাবে পুরনো পন্থী চিন্তাভাবনায় জর্জরিত নয়। কোন বিষয়গুলো মনে ঠাঁই দেওয়া উচিত আর কি কি জিনিস জীবন থেকে দূরে রাখলে মানুষ অনেক সুস্থ হয়ে চলতে পারবে সে নিয়ে জ্ঞান তাদের ছিল।
দুইটি পরিবারে আরেকটি ভালোলাগা ছিল যেটি হলো রেডিও শোনা। বলা যায়, প্রায় সারাদিন তাদের উদ্বেগহীন জীবনে রেডিও ঘরে সঙ্গ দিয়েই যেত।
এবার আসি সমরেশ আর ললিতার কাছে। সমরেশ এর বিষয় অঙ্ক আর ললিতা পড়ে ভূগোল বিভাগে। দুজনের সম্পর্ক বলতে শুধু দুজন রোজ সকালে একসঙ্গে রাস্তা পার করে, তারপর যে যার নিজ কলেজের দিকে রওনা হয়। একজন না আসা পর্যন্ত অন্যজন দাঁড়িয়ে থাকে। ওই একবার দেখার নেশা, ওইটুকু কাছে পাওয়া। এই সম্পর্কের গভীরতা কেবল ওই দুইটি মানুষ ছাড়া আর কেউ জানলো না। ওদের সম্পর্কে আর কিছু না থাক, অপেক্ষা ছিল। সেটাই তাদের ভাষা। সেখানেই ভালোবাসার প্রকাশ।
সমরেশের অত প্রেম সম্পর্কিত জটিলতায় মন দেবার সময় নেই আর সে চাইতও না। কিন্তু ললিতাকে দেখে তার সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেত। ললিতাও জানতো, এর বেশি সমরেশকে বোঝালে, সমরেশ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং, এইরকম শান্তভাবে, নির্বিঘ্নে তাদের সম্পর্কের বাঁধন চলতে থাকলো।
সমরেশ জানত, ললিতা গান ভালোবাসে ভীষণ। শুধু ললিতাকে কাছে পাওয়ার জন্য সে রেডিও এ গান শুনতো খুব। লোকে ভাবতো বুঝি সঙ্গীতপ্রেমী। তবে প্রেমটা যে কোথায়, সে কথা মনে মনে কেবল সে নিজেই বুঝতো।
এমন নিস্তরঙ্গ সময়ে ললিতার জীবনে একটা কান্ড ঘটল। তাকে পড়াশুনোর জন্য চলে যেতে হলো দিল্লি। ললিতাও উচ্চাকাঙ্খী, সঙ্গে তার পরিবারও। তার এক চিলতে মন ওই পুরনো পাড়ায় ফেলে গেলো কেবল। সে মনকে বোঝাতে লাগলো, সমরেশ তার মনের কথা জানে না। সুতরাং আর জানতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সমরেশ কি ভাবে? সমরেশ, এই হেন ঘটনায় কি করবে কিচ্ছু না বুঝে, চুপ করে রইলো।
বছর পেরিয়েছে চার। দিল্লিতে সকালে রবিবারের দিন। ললিতার রেডিও শোনার অভ্যেস ছোটেনি। বিশেষ করে তার বাবা এখনও নিয়ম করে শোনেন। অনুষ্ঠান চলছে কি যেনো... হঠাৎ ললিতা কাগজ হাতে শুনতে পেলো, কলকাতা থেকে সমরেশ চট্টোপাধ্যায় এর অনুরোধে গান, ললিতার উদ্দেশ্যে..
এক নিমেষে ললিতার সময় থেমে গেলো। পাশে শুধু বাজতে লাগলো, "আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে...."।
এরপর গল্প আর বেশি নেই। আর জেনে আমাদের লাভও নেই। সমরেশের যে ললিতার কাছে মন প্রকাশের ইচ্ছে এসেছে আর ললিতার যে এতদিনের সকল চিন্তা চুরমার হয়ে ভেঙে গেলো শুধু নিজের কাছে স্বীকার করে; সমরেশ সব জানে এবং সেই সবই বুকে করে নিয়ে চলেছে- এর ভার কম নয়।
গান শেষ হল। রেডিও এ তখন অন্য নাম, আরেকটি গানের আবেদনে বেজে চলেছে।
____________________
'অপেক্ষা', 'ভাষা'-গুলি একপক্ষীয় হলে মনে হয় গল্প তৈরি হয়না।
ReplyDelete